দেবী দুর্গার উত্থান

বাংলায় দেবী দুর্গার উত্থান ও বিকাশের ইতিবৃত্ত




দেবী দুর্গার পরিচয় দিতে গিয়ে সুধীরচন্দ্র সরকার লিখেছেন, ‘পরমাপ্রকৃতি, বিশ্বের আদি কারণ ও শিবপত্নী।’ এই বাক্যটিতে যেন দেবী দুর্গার প্রকৃত পরিচয় অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে ... যে রূপসী মাতৃদেবী বাংলায় পূজিত হন শরৎকালে, যখন নীলাভ আকাশে ফুরফুরে হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় সাদা সাদা মেঘের ভেলা, নদীর ধারে উজ্জ্বল রোদে ফুটে থাকে বাতাসে দোল খাওয়া শাদা শাদা কাশের ফুল আর গ্রামীণ জনপদে দেবীর আগমনী ঘোষনায় উন্মাতাল ঢাকের শব্দে বাঙালির আদিম রক্তস্রোতে জেগে ওঠে এক আদিম মাতৃভক্ত নিষাদ ...





শিল্পীর তুলিতে পরমাপ্রকৃতি, বিশ্বের আদি কারণ ও শিবপত্নী দুর্গা ।

শরৎকাল থেকে বসন্ত কাল পর্যন্ত বাঙালির পূজার সময়; শারদীয়া দুর্গা পূজা দিয়ে এই বাৎসরিক মাতৃপূজার শুভ সূচনা। মনে রাখতে হবে - প্রাচীন বৈদিক আর্যরা করত যজ্ঞ। সে যজ্ঞে পশুবলি হত। বাংলা, প্রাচীন কাল থেকেই যজ্ঞ না করে করত পূজা। ‘পূজা’ শব্দটি অস্ট্রিক ভাষার শব্দ, যে ভাষায় প্রাচীন বাংলার অধিবাসীরা কথা বলত, এবং এ কারণেই ভাষাটি অনার্য।

প্রাচীন ভারতে এক আশ্চর্য মানবিক ঘটনা ঘটেছিল ... বুদ্ধ-মহাবীর প্রমূখ অহিংসপন্থীদের প্রবল আন্দোলনের ফলে রক্তস্নাত বিভৎস যজ্ঞ পরিনত হয়েছিল পবিত্র তীর্থে। প্রাচীন মানুষের মন যজ্ঞ থেকে তীর্থে ঘুরে গিয়েছিল। প্রাচীন বাংলায় জৈন ও বুদ্ধ ধর্মের ভারি সম্মান ছিল। পুন্ড্রনগর হয়ে উঠেছিল জৈন ও বুদ্ধ ধর্মের প্রধান কেন্দ্র। এতে করে অহিংস বাঙালি মনের পরিচয় পাওয়া যায়।



দেবী মায়ের পূজার জন্য নয়নাভিরাম শরৎকালই বেছে নিয়েছে প্রকৃতিপ্রেমিক শিল্পরসিক বাঙালি

বাংলা অবৈদিক আর অনার্য বলেই চিরকালই ছিল পূজা-অর্চনার দেশ। বাঙালি সুপ্রাচীন কাল থেকেই বহু লোকায়ত দেবদেবীর পূর্জা-অর্চনা করত । গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসুর "বাংলার লৌকিক দেবতা" বইটি থেকে আমরা প্রায় পঁয়ত্রিশটি লৌকিক দেব-দেবীর নাম জানতে পেরেছি। এরা আসলে ছিল বৌদ্ধধর্মের দেবদেবী, বাংলায় বৌদ্ধযুগের অবসানকালে শিবের পক্ষভুক্ত হয়ে যায়।

... অস্ট্রিকভাষী নিষাদেরা প্রাচীন বাংলার গভীর অরণ্যে ‘বোঙ্গা’ দেবতার পূজা করত । কোনও কোনও পন্ডিতের ধারণা ওই ‘বোঙ্গা’ থেকেই বাংলা শব্দের উদ্ভব ।

সে যাই হোক। বাংলার লোকায়ত দেব-দেবীর রূপ কিন্তু কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে, সেই সঙ্গে বদলেছে পূজা-অর্চনার ধরন-ধারণও । তবে সে পরিবর্তিত রূপের মধ্যেও যেন বিশ্বের আদি কারণরূপী এক মহামাতৃদেবীকে পাওয়া যায়। তিনিই শিবপত্নী দুর্গা।



শিব। দুর্গার এক পরিচয়-তিনি শিবপত্নী। শিবই সর্বভারতীয় প্রধান দেবতা। শিবের ইতিহাস কম বিস্ময়কর নয়। কেননা, শিব অনার্য দেবতা, বৈদিক দেবতা নন; ব্রহ্মা, বিষ্ণু-প্রমূখ বৈদিক দেবতাকে অপসারণ করে শিবের সর্বভারতীয় দেবতায় মর্যাদা লাভ যেন ভারতীয় অনার্য ভূমিপুত্রদের বিজয়েরই প্রতীক। শিবের স্ত্রী হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে পার্বতী উমা গঙ্গা দুর্গা ও কালীকে। শিবের পুত্র- গনেশ ও কার্তিক। কন্যা- মনসা ও লক্ষী।



শিব ও দুর্গা। সুখতৃষ্ণার্ত মানুষের একান্ত মনের প্রতিচ্ছবি। এ রকম সুখি যুগল জীবন মানুষের জন্মজন্মান্তরের কামনা ...



দেবী দুর্গার অতি পরিচিত এই প্রতিমাটির ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার। তবে এ ব্যাখ্যা বাংলার নয়, যদিও ব্যাখ্যাটি বাংলায় গৃহিত হয়েছে ...ব্যাখ্যাটি পৌরাণিক আর্যদের ...একবার মহিষাসুরের (মহিষ+অসুর=মহিষাসুর) ধারণা হল সে কোনও দেবতা তাকে বধ করতে পারবে না; এই অহংকারে মহিষাসুর দেবতা ইন্দ্রকে সর্তক করে দেয় যে সে স্বর্গ জয় করে নেবে। মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে ইন্দ্র ব্রহ্মা, শিব ও বিষ্ণুর আশ্রয় নেয়। দেবতারা ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠেন এবং তাদের পবিত্র দেহ থেকে স্বর্গীয় সুষমায় আচ্ছন্ন অপূর্ব সুন্দরী এক নারীর জন্ম হয়। ইনিই দুর্গা! একজন দেবতা দুর্গাকে অস্ত্র দিলেন, অন্যজন দিলেন বাহন ... সিংহ, অন্যজন মদ। এরপর যুদ্ধে দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেন। পৌরাণিক আর্যদের ব্যাখ্যায় দুর্গা কিছুটা উগ্র, স্বাধীন ও কারও স্ত্রী নন।

কিন্তু, বাংলায় দুর্গা পূজার প্রচলন কবে হয়েছে?
সুপ্রাচীনকালে বাংলায়, আজ আমরা মন্ডপে- মন্ডপে যেভাবে দুর্গা পূজা দেখছি ঠিক সেভাবে দুর্গা পূজার প্রচলন ছিল না-এই হল পন্ডিতদের অভিমত। (দ্র; ড. আর. এম দেবনাথ; সিন্ধু থেকে হিন্দু ; পৃষ্ঠা, ৮২) ... বাংলায় দুর্গা পূজার প্রচলন দ্বাদশ শতক থেকে। অর্থাৎ, ‘গীতগোবিন্দের’ রচয়িতা কবি জয়দেব যে শতাব্দীতে বেঁচে ছিলেন সেই শতাব্দীতে। অবশ্য দুর্গা পূজার বিধান রচিত হয়েছে আরও অনেক পরে। দুর্গা পূজার বিধান সম্বলিত রঘুনন্দনের (১৫০০/১৫৭৫) ‘দুর্গাপূজাতত্ত্ব’ গ্রন্থটি রচিত হয় ষোড়শ শতাব্দীতে। রঘুনন্দন ভট্টাচার্য নবদ্বীপের বিশিষ্ট তান্ত্রিক পন্ডিত ছিলেন।

মনে রাখতে হবে, বাংলার হিন্দুধর্মটি হল তান্ত্রিক হিন্দুধর্ম। তন্ত্র হল বেদবিরোধী এবং সাধনার বিষয়। যে কারণে বাঙালি তান্ত্রিকেরা দুর্গাকে পরমাপ্রকৃতি, বিশ্বের আদি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আর পৌরাণিক আর্যদের মতে দুর্গা ব্রহ্মা,শিব ও বিষ্ণুকর্তৃক সৃষ্ট দেবী!
বাংলা ভাষা যেমন সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেও নিজস্ব স্বরূপের জন্য সদাসর্বদা সংগ্রাম করে চলেছে, বাংলার হিন্দুধর্মও ঠিক সেরকমই তার স্থানীয় বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্য সদাসর্বদা বৈদিক ধ্যানধারণা বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে চলেছে। এ কারণেই ভারতবর্ষের পশ্চিমের আর্যপ্রভাবিত অঞ্চলে শিব ও দুর্গার পুত্র গনেশ পূজার চল থাকলেও (তান্ত্রিক) দুর্গার পূজার চল নেই।



দ্বাদশ শতক থেকে বাংলায় দুর্গা পূজার প্রচলন হলেও বর্তমানরূপে পাওয়া যায় ওই ষোড়শ শতাব্দী থেকেই।

তবে ঐতিহাসিকেরা যাই বলুক না কেন-ধান ও শস্যের এই দেশে দেবী দুর্গার প্রাচীনতা নিয়েও সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। প্রাচীনকালে দুর্গাপূজা শস্যপূজারূপে বিরাজমান ছিল। পৃথিবী প্রাণশক্তি ও প্রজনন শক্তির প্রতীক হিসেবে প্রাচীনকাল থেকেই পূজিতা। প্রাচীন বাংলার কৃষিজীবি জনগন পৃথিবীকে মনে করত শস্যোৎপাদিনী মাতৃদেবী। এই ‘পৃথিবীদেবীর’ পূজা থেকেই পরবর্তীকালে ‘শস্যদেবী’ ও শস্যপূজার উৎপত্তি হয়েছে। এ কারণে পৃথিবীর দান শস্য দুর্গাপূজার একটি বড় দিক। দুর্গা পূজায় দেবীর বোধন হয় ষষ্ঠীর দিনে। বোধনের প্রতীক বিল্বশাখা (বা বেলগাছের ডাল) । পরে দেবীর স্নান, প্রতিষ্ঠা ও পূজা হয় নবপত্রিকায়। ‘ নবপত্রিকা’ হচ্ছে ‘শস্যবধূ’। একটি কলাগাছের সঙ্গে কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), ডালিম, মানকচু, অশোক ও ধান একত্রে বেধে এই শস্যবধূ তৈরি করা হয়। এই নবপত্রিকা বা শস্যবধূকেই ‘দেবীর’ প্রতীক হিসেবে প্রথম পূজা করতে হয়।



বাঙালি নারীর ভিতরে যেন সহজাত দুর্গাভাব রয়েছে ... কেননা প্রাচীনকালে দুর্গাপূজা শস্যপূজারূপে বিরাজমান ছিল। পৃথিবী প্রাণশক্তি ও প্রজনন শক্তির প্রতীক হিসেবে প্রাচীনকাল থেকেই পূজিতা।

শস্যপূজার ধারার সঙ্গে পার্বতী-উমার ধারা মিশ্রত হয়েছে। দুর্গার আরেক নাম উমা। উমাকে বলা হয় হিমালয়-দুহিতা। যার বাহন সিংহ। সিংহবাহিনী পর্বতকন্যা উমা-পার্বতীই ভারতবর্ষের শক্তি দেবীর প্রাচীন রূপ। (এর আর্য পৌরাণিক ব্যাখ্যা আমরা জেনেছি) এই সিংহবাহিনী পর্বতকন্যা উমা-পার্বতী র সঙ্গে শস্যপূজার ধারা মিশে এক মহাদেবীর সৃষ্টি হয়েছে। ইনিই দুর্গা।



শস্যপূজার ধারা এবং উমা-পার্বতীর ধারার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি ধারার। অসুরনাশিনী ধারা। (এরও আর্য পৌরাণিক ব্যাখ্যা আমরা জেনেছি) যে কারণে বিশ্বাস করা হয়- যিনি দুর্গতিনাশিনী তিনিই দুর্গা। যিনি দুর্গম ভবসাগরে নৌকাস্বরূপ তিনিই দুর্গা। এসবই অসুরনাশিনী ধারার অর্ন্তগত। এবং বর্তমানকালেও স্বীকৃত। যদিও এটি ব্রাহ্মণ্য সংযোজন। যা হোক। এভাবেই দুর্গার রূপ বহুমূখী হয়েছে। একদিকে রয়েছে দেবীর কল্যাণরূপী, স্ত্রীরূপী ও মাধুর্যমন্ডিত রূপ অন্যদিকে আছে ব্রাহ্মণ্য সংযোজন অসুরনাশিনী রূপ। অবশ্য অসুরনাশিনী (চন্ডী) এবং ‘যুদ্ধং দেহী’ দুর্গারূপ বাঙালি হিন্দুরা গ্রহন করেনি। বাঙালি গ্রহন করেছে দেবীর কোমল-স্নিগ্ধ মাতৃরূপকে।



ফসল ওঠার পূর্বে শরৎকালে দুর্গা তাঁর পুত্র-কন্যা নিয়ে স্বামীর গৃহ কৈলাস থেকে পিতৃগৃহে আসেন। এই রূপটিতে বাঙালি হিন্দুর দৈনন্দিন জীবনের একটি প্রতিফলন ঘটেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলায় দুর্গা পূজাই সবচে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। একটা সময় ছিল যখন দুর্গা পূজা পারিবারিক ভাবে পালন করা হত। জমিদার ও ধনাঢ্য বৈশ্যরাই ছিল এর উদ্যোক্তা-বাকিরা দর্শক। কালক্রমে সেই পারিবারিক পূজাই হয়ে ওঠে বারোয়ারি পূজা। আজকাল এই পূজার রূপ সর্বজনীন। প্রতিমা তৈরি, পূজার মন্ডপ নির্মাণ, চাঁদা সংগ্রহ, দেবী দর্শন, আরতি দর্শন ও প্রতিমা বিসর্জন -এসবই উৎসবমূখর সাধারণ হিন্দুদের ব্যাপক অংশ গ্রহনের ফলেই সম্ভব হয়েছে।



মানচিত্রের দিকে তাকালে বোঝা যায় উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে সিন্ধু ও বেলুচিস্তানে শিবকে দিয়ে যে হিন্দুধর্মের যাত্রা শুরু হয়েছিল, পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে বাংলায় দুর্গা ও কালীকে দিয়ে সে ধর্মযাত্রার সমাপ্ত হয়...



মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ